লাহোরে প্রস্তাবের ইতিবৃত্ত
মোঃসবুজ আহমেদ জীবন,জেলা প্রতিনিধি, হবিগঞ্জঃ আজ শেরে বাংলা কর্তৃক ঐতিহাসিক লাহোরে প্রস্তাব উত্থাপন দিবস /পাকিস্তান প্রজাতন্ত্র দিবস। তো ইতিহাসের পাতায় জেনে নেওয়ার সেই দিবসটির ইতিবৃত্ত:
লাহোর প্রস্তাব বা পাকিস্তান প্রস্তাব, যাকে পাকিস্তানের স্বাধীনতার ঘোষণাও বলা হয়, তা হচ্ছে ভারতীয় উপমহাদেশে বসবাসকারী মুসলিমদের জন্য একটি পৃথক রাষ্ট্রের দাবী জানিয়ে উত্থাপিত প্রস্তাবনা। ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ লাহোরে অনুষ্ঠিত মুসলীম লীগের অধিবেশনে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ এর সভাপতিত্বে মুসলিম লীগের পক্ষ হতে ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের প্রারম্ভিক খসড়া তৈরি করেন পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী সিকান্দার হায়াত খান যা আলোচনা ও সংশোধনের জন্য নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সাবজেক্ট কমিটি সমীপে পেশ করা হয়। সাবজেক্ট কমিটি এ প্রস্তাবটিতে আমূল সংশোধন আনয়নের পর ২৩ মার্চ সাধারণ অধিবেশনে মুসলিম লীগের পক্ষ হতে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী আবুল কাশেম ফজলুল হক সেটি উপস্থাপন করেন এবং চৌধুরী খালিকুজ্জামান ও অন্যান্য মুসলিম নেতৃবৃন্দ তা সমর্থন করেন। মূল প্রস্তাবটি ছিল উর্দু ভাষায়। এই সম্মেলনে ফজলুল হককে “শেরে বাংলা” উপাধি দেয়া হয়।
পাকিস্তান প্রস্তাবের ইতিহাস
১৯৪০ খ্রীস্টাব্দের ২৩ মার্চ নিখিল ভারত মুসলীম লীগের অধিবেশনে ভারতের উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর-পূর্বাঞ্চল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলসমূহে একাধিক স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার একটি প্রস্তাব গৃহীত করা হয়।এটিই ঐতিহাসিক ‘লাহোরে প্রস্তাব’ ন্যামে খ্যাত।বলা হয়ে থাকে যে লাহোরে প্রস্তাবের মধ্যে বাংলাদশের স্বাধীনতার বীজ বুনা ছিল। যদিও তা পরবর্তীতে (১৯৪৬) সংশোধন করা হয়ে একটি রাষ্ট্র গঠন করা হয়।কিন্তু পাকিস্তান পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ব বাংলার জনগণ সেই লাহোরে প্রস্তাবে অনুপ্রাণিত হয়ে বাংলায় সায়ত্তশাসনের দাবি আদায়ের আন্দোলন শুরু করে। যা পরবর্তীতে স্বাধীনতার আন্দোলনে পরিণত হয়।।
১৯৪০ সালের ঐতিহাসিক লাহোরে প্রস্তাবনাটির মূল বৈশিষ্ট্যসমূহ ছিলোঃ
প্রথমতঃ নিখিল ভারত মুসলিম লীগ দৃঢ়তার সাথে পুন:ঘোষণা করছে যে, ১৯৩৫ খ্রীস্টাব্দের ভারত শাসন আইন-এ যে যুক্তরাষ্ট্রের (Federal) পরিকল্পনা রয়েছে, তা এ দেশের উদ্ভূত অবস্থাুতপ্রেক্ষিতে অসঙ্গত ও অকার্যকর বিধায় তা ভারতীয় মুসলমানদের জন্য অগ্রহণযোগ্য।
দ্বিতীয়তঃ সমস্ত সাংবিধানিক পরিকল্পনা নতুনভাবে বিবেচনা না করা হলে মুসলিম ভারত অসন্তুষ্ট হবে এবং মুসলমানদের অনুমোদন ও সম্মতি ব্যতিরেকে সংবিধান রচিত হলে কোন সংশোধিত পরিকল্পনা ও তাদের নিকট গ্রহণযোগ্য হবে না।
তৃতীয়তঃ নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সুচিন্তিত অভিমত এরূপ যে, ভারতে কোন শাসনতান্ত্রিক পরিকল্পনা কার্যকর হবে না যদি তা নিম্নবর্ণিত মূলনীতির উপর ভিত্তি করে রচিত না হয়:
ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী সংলগ্ন বা সন্নিহিত স্থানসমূহকে ‘অঞ্চল’ হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে,
প্রয়োজন অনুযায়ী সীমানা পরিবর্তন করে এমনভাবে গঠন করতে হবে যেখানে ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান এলাকাগুলো ‘স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ’ (Independent States) গঠন করতে পারে,
‘স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহের’ সংশ্লিষ্ট অঙ্গরাষ্ট্র বা প্রদেশসমূহ হবে স্বায়ত্বশাসিত ও সার্বভৌম।
চতুর্থতঃ এ সমস্ত অঞ্চলের সংখ্যালঘুদের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অন্যান্য অধিকার ও স্বার্থরক্ষার জন্য তাদের সাথে পরামর্শ সাপেক্ষে সংবিধানের কার্যকর ও বাধ্যতামূলক বিধান রাখতে হবে। ভারতবর্ষের মুসলমান জনগণ যেখানে সংখ্যালঘু সেখানে তাদের সাথে পরামর্শ সাপেক্ষে এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সাথেও আলোচনা সাপেক্ষে সংবিধানে কার্যকর বিধান রাখতে হবে।
মূল প্রস্তাবের সংশোধন:
মূল লাহোরে প্রস্তাবে ভারতের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলেরর সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম অঞ্চল নিয়ে “স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ “গঠন করার কথা বলা হয়।প্রস্তাবে কোথাও একটি রাষ্ট্র গঠনের কথা উল্লেখ ছিল না।জিন্নাহ শীঘ্রই এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “ভারতের পশ্চিম-ভাগের মুসলিম প্রধান প্রদেশগুলো এবং পূর্বভাগের মুসলিম প্রধান বাংলা ও আসামকে নিয়ে পাকিস্তান একটি যুক্তরাষ্ট্রই হবে।পরবর্তীতে লন্ডনের পত্রিকাগুলো লাহোরে প্রস্তাবকে ‘পাকিস্তান প্রস্তাব’ বলে অভিহিত করে। অবশেষে ১৯৪৬ সালের ৯ এপ্রিল মুসলিম লীগের আইন প্রণেতাগণ সম্মেলনে একাধিক রাষ্ট্র কথাটি সংশোধন করে একটি রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব গৃহীত হয়।বাংলার মুসলিম লীগ নেতা (সাধারণ সম্পাদক) আবুল হাশিম লাহোরে প্রস্তাব সংশোধনের প্রচন্ড বিরোধিতা করে।তিনি বলেন, ‘অন্য একটি রাষ্ট্রের প্রায় ১০০০ মাইল ভূ-ভাগ দ্বারা ২টি বিছিন্ন দূরবর্তী অঞ্চল নিয়ে কখনো একটি রাষ্ট্র গঠিত হতে পারে না”।কিন্তু জিন্নাহ তাকে বুঝানোর চেষ্টা করে, অসাবধানতা & ছাপার ভূলে State শব্দটির s সাথে যোগ হয়েছে।অথচ প্রস্তাবে বারবার States শব্দটি ব্যবহার লক্ষ্য করা গেছে।এই শব্দ পরিবর্তনের ঘটনা ছিল মূলত উদ্দেশ্য প্রণিত এবং ষড়যন্ত্রমূলক।।
Leave a Reply